জানা গিয়েছে, শুক্লার বিস্তৃত প্রশিক্ষণ স্পেসএক্সের সদর দপ্তরে সম্পন্ন হয়েছে, যা অক্সিওম-৪ মিশনের প্রস্তুতির অংশ
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে, ভারতের গগনযান প্রকল্পের মহাকাশচারী শুভাংশু শুক্লা স্পেসএক্সের ড্রাগন মহাকাশযানে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এই উদ্যোগটি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মহাকাশ অনুসন্ধান সংক্রান্ত অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করার প্রতিফলন ঘটায়, যেখানে নাসা, স্পেসএক্স এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) একত্রে কাজ করছে।

শুক্লার প্রশিক্ষণ, যা এই মাসের শুরুতে স্পেসএক্সের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, অক্সিওম-৪ মিশনের প্রস্তুতির অংশ, যা একটি বেসরকারি মহাকাশচারী মিশন হিসেবে মহাকাশচারীদের আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) নিয়ে যাবে। ২০২৫ সালের বসন্তে অনুষ্ঠিতব্য এই মিশনটি ভারতের মানব মহাকাশ উড়ান কর্মসূচির একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।

অক্সিওম-৪ মিশনের দলনেতা মহাকাশচারী পেগি হুইটসন ১৭ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ জানান যে মিশনের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। তিনি লেখেন, “এক্স-৪ মিশনের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে এবং আমি ইতিমধ্যেই নিজেকে বাড়ির মতো অনুভব করছি। হিউস্টনে ব্যাপক অনবোর্ডিং প্রক্রিয়া শেষে আমরা @স্পেস এক্স-এ এসেছি পোশাক মাপ এবং চাপপরীক্ষার জন্য। দলটি ড্রাগনের সাথে প্রথম পরিচয়ও সম্পন্ন করেছে!” তার পোস্টে তিনি ড্রাগনের চারজন ক্রু সদস্যদের একটি ছবিও শেয়ার করেন।

স্পেসএক্সে প্রশিক্ষণ: ড্রাগনের জন্য প্রস্তুতি
শুভাংশু শুক্লা এবং তার অক্সিওম-৪ দলের সদস্যরা স্পেসএক্সের সদর দপ্তরে কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এই প্রশিক্ষণে পুরো ফ্লাইট প্রক্রিয়ার সিমুলেশন অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা মহাকাশচারীদের ড্রাগন মহাকাশযানের জটিল সিস্টেম ও প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত করেছে। নিরাপত্তা ও জরুরি প্রস্তুতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, যেখানে মহাকাশচারীরা চাপযুক্ত স্যুটে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন, যা মিশনের সময় তারা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন তার অনুকরণ করেছে।

ড্রাগন মহাকাশযান, যা স্পেসএক্স আইএসএসে ক্রু পরিবহনের জন্য তৈরি করেছে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। শুক্লা প্রশিক্ষণের সময় মহাকাশযানের সূক্ষ্ম সিস্টেম এবং নিয়ন্ত্রণগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেন। মহাকাশচারীরা ব্যাপক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ নেন, যা মহাকাশযানটির ডকিং, আনডকিং এবং নিয়ন্ত্রণের সিমুলেশন করে বাস্তব সময়ের মহাকাশ অপারেশনগুলিকে অনুকরণ করেছে।

অক্সিওম-৪ মিশনের অংশ হিসেবে, শুক্লা প্রায় ১০ দিন আইএসএস-এ কাটাবেন, যেখানে তিনি বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরীক্ষা করবেন। এই মিশনটি ভারতের মহাকাশ উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কৌশলগত গুরুত্বকে তুলে ধরে। নাসা ও স্পেসএক্সের সমর্থনে শুক্লার স্পেসএক্সে প্রশিক্ষণ তাকে মহাকাশযানের অভ্যন্তরীণ সিস্টেমের সাথে পরিচিত করানোর উদ্দেশ্যে ছিল, যাতে আইএসএস-এ পৌঁছানোর পর তার অভিজ্ঞতা নির্বিঘ্ন হয়।

আইএসএস-এ থাকার সময় শুক্লা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অংশ নেবেন, যার কিছু গবেষণা ভারত এবং বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের জন্যও উপকারী হবে। এই গবেষণাগুলো জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি পরীক্ষার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচালিত হবে।

প্রশিক্ষণে রুটিন অপারেশন এবং জরুরি প্রতিক্রিয়ার বাস্তব সময়ের সিমুলেশন অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা শুক্লা ও তার সহকর্মীদের মিশনের সময় যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করেছে।

ভারত-মার্কিন মহাকাশ সহযোগিতা শক্তিশালীকরণ
শুক্লার এই মিশনটি নাসা, স্পেসএক্স এবং ইসরোর মধ্যে একটি বৃহত্তর অংশীদারিত্বের অংশ, যা ২০২৩ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই অংশীদারিত্বের মধ্যে উন্নত মহাকাশচারী প্রশিক্ষণ এবং নাসার কারিগরি সহায়তা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা মহাকাশ অনুসন্ধানে দুটি দেশের সহযোগিতার ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিকে প্রতিফলিত করে।

নাসার প্রশাসক বিল নেলসন গত বছর নয়া দিল্লি সফরের সময় ভারতীয় মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষণের প্রতি নাসার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে শুক্লার প্রশিক্ষণ এই আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ভারতের মানব মহাকাশযাত্রার সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।

যদিও শুক্লার মিশন ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, দেশের উচ্চাভিলাষী গগনযান মিশনটি এখনও পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। গগনযান কর্মসূচির লক্ষ্য ভারতীয় মহাকাশচারীদের ভারতীয় মহাকাশযানে মহাকাশে পাঠানো, যার প্রথম মানব মিশন ২০২৫ সালের আগে চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর আগে ইসরো দুটি মনুষ্যবিহীন মিশন পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেছে, যাতে মানব মিশনের নিরাপত্তা এবং সাফল্য নিশ্চিত করা যায়।

নাসা এবং স্পেসএক্সের সাথে এই সহযোগিতা ভারতের মহাকাশ উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি পথ হিসেবে দেখা হচ্ছে। অক্সিওম-৪ এর মতো আন্তর্জাতিক মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইসরোর মহাকাশচারীরা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন, যা ভবিষ্যতে ভারতের মহাকাশ মিশনের জন্য সহায়ক হবে।

অক্সিওম-৪ মিশন: এক ধাপ এগিয়ে
অক্সিওম-৪ মিশনটি নাসা এবং অক্সিওম স্পেসের মধ্যে চতুর্থ বেসরকারি মহাকাশচারী মিশন। এই মিশনের লক্ষ্য হলো বেসরকারি নাগরিক এবং গবেষকদের আইএসএস-এ প্রবেশের সুযোগ প্রদান করা, যেখানে তারা মাইক্রোগ্রাভিটি অবস্থায় বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে পারবেন। নাসা স্পেসএক্সকে আইএসএসে পরিবহন এবং ফেরত আনার জন্য দায়িত্ব দিয়েছে, যেখানে মহাকাশচারীদের ড্রাগন মহাকাশযানে সিস্টেম, প্রক্রিয়া এবং জরুরি প্রস্তুতির ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

শুভাংশু শুক্লা তার প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে শুধু মহাকাশযানে নয়, বরং আইএসএস মডিউল এবং প্রোটোকলের ওপরও বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এর ফলে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রু সদস্যদের সঙ্গে কাজ করার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত এবং মিশনের সময় আইএসএস পরিবেশে দক্ষভাবে চলাফেরা করতে পারবেন।

শুভাংশু শুক্লার অক্সিওম-৪ মিশনে অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক মহাকাশ অনুসন্ধানে ভারতের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার প্রতিফলন ঘটায়। নাসা এবং স্পেসএক্সের সমর্থনে, ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচি মানব মহাকাশ উড়ানের লক্ষ্যে সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে। মিশনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ভারত তার মহাকাশচারীর আইএসএস-এ যাত্রার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে, যা নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক মহাকাশ সম্প্রদায়ে ভারতের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করবে।

অক্সিওম-৪ মিশন ভারত-মার্কিন সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, এবং শুক্লার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে ভারতের মহাকাশ উদ্যোগের ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক